আল-কুরআন আল্লাহ তায়ালার পবিত্র বাণী। এটি মুসলিমগণের। ধর্মগ্রন্থ। কুরআন মজিদ বরকতময় গ্রন্থ। মানুষের প্রতি এটি আল্লাহ তায়ালার একটি বিশেষ নিয়ামত। আল্লাহ তায়ালা মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর উপর সুদীর্ঘ ২৩ বছরে এটি নাজিল করেন। আসমানি কিতাবসমূহের মধ্যে এটি সর্বশেষে নাজিল করা হয়েছে। এরপর আর কোনো কিতাব আসেনি। আর ভবিষ্যতেও আসবে না। কিয়ামত পর্যন্ত এ কিতাবের বিধি-বিধান ও শিক্ষা বলবৎ থাকবে। এটি সর্বকালের সকল মানুষের জন্য হিদায়াতের উৎসস্বরূপ। আল-কুরআনের নির্দেশনা মেনে চললে মানুষ দুনিয়াতে শান্তি ও সম্মান পাবে। আর আখিরাতে চিরশান্তির জান্নাত লাভ করবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন-
وَهُذَا كِتُبْ أَنْزَلْتُهُ مُبْرَكَ فَاتَّبِعُوهُ وَاتَّقُوا لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُوْنَ لا
অর্থ: "এই কিতাব আমি নাজিল করেছি, যা কল্যাণময়। অতএব, তোমরা এর অনুসরণ কর এবং সাবধান হও, হয়তো তোমাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করা হবে।" (সূরা আল-আন'আম, আয়াত ১৫৫)
অবতরণ
আল্লাহ তায়ালা আল-কুরআন আমাদের প্রিয় নবি হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর উপর নাজিল করেন। আল-কুরআন 'লাওহে মাহফুয' বা সংরক্ষিত ফলকে লিপিবদ্ধ আছে। 'লাওহে মাহফুয' অর্থ সংরক্ষিত ফলক। আল্লাহ তায়ালা বলেন-
بَلْ هُوَ قُرْ أَنْ مَّجِيدٌ فِي لَوْحٍ مَّحْفُوظ :
অর্থ: "বস্তুত এটি সম্মানিত কুরআন। সংরক্ষিত ফলকে লিপিবদ্ধ।" (সূরা আল-বুরুজ, আয়াত ২১-২২)
লাওহে মাহফুয থেকে আল-কুরআন প্রথমে কদরের রাতে প্রথম আসমানের 'বায়তুল ইয্যাহ' নামক স্থানে একসাথে অবতীর্ণ হয়। এটি ছিল রমযান মাসের লাইলাতুল কদর বা মহিমান্বিত রাত। আমরা এ রাতকে শবে কদরও বলে থাকি। এরপর প্রথম আসমান থেকে অল্প অল্প করে পুরো কুরআন মজিদ প্রিয় নবি (স.)-এর উপর নাজিল করা হয়।
মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স.) ছিলেন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবি। তিনি আরব দেশের মক্কা নগরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মের সময় গোটা আরব ছিল অজ্ঞতা ও বর্বরতায় আচ্ছন্ন। তারা নানা মূর্তির পূজা করত। নানারূপ অন্যায় ও অশ্লীল কাজ করত। ঐতিহাসিকগণ সে সময়কে 'আইয়ামে জাহেলিয়া' নামে আখ্যায়িত করেছেন। আইয়ামে জাহেলিয়া অর্থ অজ্ঞতার যুগ।
নবি করিম (স.) আরবদের এরূপ অজ্ঞতা ও বর্বরতা পছন্দ করতেন না। তিনি সবসময় সত্য ও সুন্দরের অনুসন্ধান করতেন। এজন্য তিনি হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন থাকতেন। হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন অবস্থাতেই তাঁর নিকট সর্বপ্রথম কুরআনের বাণী নাজিল হয়। তিনি সত্যের সন্ধান পান। তখন তাঁর বয়স ছিল চল্লিশ বছর। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে শেষ নবি ও রাসুল হিসেবে মনোনীত করেন। এ সময় মহান আল্লাহর নির্দেশে হযরত জিবরাইল (আ.) সূরা আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত নিয়ে তাঁর নিকট আগমন করেন। এটিই ছিল সর্বপ্রথম ওহি। এরপর মহানবি (স.) আরও ২৩ বছর জীবিত ছিলেন। তাঁর জীবদ্দশায় আল্লাহ তায়ালা প্রয়োজন অনুসারে আল-কুরআনের বিভিন্ন অংশ অল্প অল্প করে নাজিল করেন। এভাবে সুদীর্ঘ ২৩ বছরে আল-কুরআন সম্পূর্ণ অবতীর্ণ হয়।
আল-কুরআন সংরক্ষণের দায়িত্ব
আল-কুরআন মহান আল্লাহর বাণী। এটি সংরক্ষণ করার দায়িত্বও তারই। তিনি স্বয়ং আল-কুরআন সংরক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-
إِنَّ عَلَيْنَا جَمْعَهُ وَقُرْآنَهُ
অর্থ: "নিশ্চয়ই এর (আল-কুরআন) সংরক্ষণ ও পাঠ করানোর দায়িত্ব আমারই।" (সূরা আল-কিয়ামাহ, আয়াত ১৭)
আল্লাহ আরও বলেন-
إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِكُرَ وَإِنَّا لَهُ لَحْفِظُونَ
অর্থ: "নিশ্চয়ই আমিই কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং অবশ্যই আমিই এর সংরক্ষক।" (সূরা আল-হিজর, আয়াত ৯)
আল-কুরআনের সংরক্ষক স্বয়ং মহান আল্লাহ। এজন্য আজ পর্যন্ত এটির কোনোরূপ পরিবর্তন হয়নি। আর ভবিষ্যতেও হবে না। এটি সকল প্রকার পরিবর্তন হতে মুক্ত। কেউ এতে নতুন কোনো কিছু সংযোজন করতে পারে না। আবার এর থেকে কোনো কিছু বাদও দিতে পারে না। আল-কুরআনের প্রতিটি হরকত, নুকতা, শব্দ, বাক্য সবকিছুই অপরিবর্তিত।
আল-কুরআন সংরক্ষণ
আল-কুরআন সর্বপ্রথম হিফয করার মাধ্যমে সংরক্ষণ করা হয়। হিফয হলো মুখস্থ করা। যাঁরা পবিত্র কুরআন হিফয করেন তাঁদেরকে বলা হয় হাফিয। আরবদের স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ। তারা খুব সহজেই নানা জিনিস স্মরণ রাখতে পারত। সম্বত আল-কুরআন মুখস্থ করার জন্যই আল্লাহ তায়ালা তাঁদের এরূপ স্মৃতিশক্তি দান করেছিলেন। কুরআন মজিদের কোনো অংশ নাজিল হলে সর্বপ্রথম মহানবি (স.) তা নিজে মুখস্থ করে নিতেন। এরপর তা সাহাবিগণকে মুখস্থ করতে বলতেন। মহানবি (স.)-এর উৎসাহ ও নির্দেশে সাহাবিগণ আল-কুরআন মুখস্থ করে রাখতেন। এভাবে কুরআন মজিদ স্মৃতিপটে সংরক্ষণ করা হয়।
আল-কুরআন লেখনীর মাধ্যমেও সংরক্ষণ করা হয়। কুরআনের কোনো অংশ নাজিল হলে তা মুখস্থ করার পাশাপাশি লিখে রাখার জন্যও নবি করিম (স.) নির্দেশ দিতেন। যে সকল সাহাবি লিখতে জানতেন তাঁরা এ দায়িত্ব পালন করতেন। তাঁদের বলা হয় কাতেবে ওহি বা ওহি লেখক। এঁদের সংখ্যা ছিল ৪২ জন। প্রধান ওহি লেখক সাহাবি ছিলেন হযরত যায়দ ইবনু সাবিত (রা.)। ওহি লেখক সাহাবিগণ সর্বদা নবি (স.)-এর সাথে থাকতেন। কুরআনের কোনো অংশ নাজিল হলে তাঁরা সাথে সাথেই তা লিখে রাখতেন। সে সময় আজকের ন্যায় কাগজ কিংবা কম্পিউটার ছিল না। তাই তখন কুরআন মজিদ খেজুর গাছের ডাল, পশুর হাড়, চামড়া, ছোট ছোট পাথর ইত্যাদিতে লিখে রাখা হতো। এভাবেও কুরআন মজিদ সংরক্ষণ করা হয়।
আল-কুরআন সংকলন
মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর জীবদ্দশায় আল-কুরআন অবতীর্ণ হয়। ফলে সে সময় গ্রন্থাকারে তা সংকলন করা হয়নি। বরং সে সময় হিফয ও লেখনীর সাহায্যে আল-কুরআনকে সংরক্ষণ করা হয়। রাসুলুল্লাহ (স.)-এর ইন্তিকালের পর আল-কুরআন সংকলন করা হয়।
মহানবি (স.)-এর ইন্তিকালের পর হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ইসলামের প্রথম খলিফা মনোনীত হন। সে সময় কতিপয় ভণ্ড নবির আবির্ভাব ঘটে। হযরত আবু বকর (রা.) সেসব ভণ্ড নবির বিরুদ্ধে জিহাদ পরিচালনা করেন। এ রকমই একটি যুদ্ধ ছিল ইয়ামামার যুদ্ধ। এ যুদ্ধে ভণ্ড নবি মুসায়লামা কায্যাবের বিরুদ্ধে মুসলমানগণ জয়লাভ করেন। তবে কুরআনের বহুসংখ্যক হাফিয শাহাদতবরণ করেন। এ অবস্থা দেখে হযরত উমর (রা.) ভাবলেন- কুরআনের হাফিযগণ এভাবে ইন্তিকাল করলে এর অনেক অংশ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তাই তিনি হযরত আবু বকর (রা.)-কে কুরআন সংকলন করার পরামর্শ দেন। হযরত উমর (রা.)-এর পরামর্শ শুনে হযরত আবু বকর (রা.) কুরআন সংকলনের উদ্যোগ নেন। তিনি প্রধান ওহি লেখক সাহাবি হযরত যায়েদ ইবনু সাবিত (রা.)-কে পবিত্র কুরআন গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করার নির্দেশ প্রদান করেন। তাঁর নির্দেশে হযরত যায়েদ ইবনু সাবিত (রা.) সাহাবিদের নিকট সংরক্ষিত কুরআনের লিখিত অংশগুলো একত্র করেন। পাশাপাশি তিনি কুরআনের হাফিযগণের সাহায্যও গ্রহণ করেন। কুরআনের প্রতিটি অংশ তিনি লেখনী ও মুখস্থ এ উভয় পদ্ধতির সাথে মিলিয়ে দেখেন। এভাবে তিনি সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে আল-কুরআনের প্রামাণ্য পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেন। আল-কুরআনের এ কপিটি খলিফা হযরত আবু বকর (রা.)-এর নিকট সংরক্ষিত ছিল। তাঁর ইন্তিকালের পর তা দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর (রা.)-এর তত্ত্বাবধানে সংরক্ষিত থাকে। হযরত উমর (রা.)-এর শাহাদতের পর এ কপিটি তাঁর মেয়ে উম্মুল মুমিনিন হযরত হাফসা (রা.)-এর নিকট সংরক্ষিত থাকে।
ইসলামের তৃতীয় খলিফা ছিলেন হযরত উসমান (রা.)। তাঁর সময়ে ইসলামি সাম্রাজ্য ছিল বিশাল-বিস্তৃত। পৃথিবীর নানা প্রান্তে ও দেশে ইসলাম ছড়িয়ে পড়েছিল। ফলে মুসলমানদের সংখ্যাও ছিল অগণিত। এ সময় বিভিন্ন অঞ্চলে কুরআনের পাঠরীতি নিয়ে মারাত্মক বিপর্যয় দেখা দেয়। এমনকি এ নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে নানা অনৈক্যের সৃষ্টি হয়। এমতাবস্থায় হযরত উসমান (রা.) বিশিষ্ট সাহাবিগণের সাথে পরামর্শ করে আল-কুরআনের একক ও প্রামাণ্য পাঠরীতি প্রচারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এজন্য তিনি হযরত যায়দ (রা.)-এর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেন। এ কমিটি হযরত হাফসা (রা.)-এর নিকট সংরক্ষিত মূল পাণ্ডুলিপি থেকে আরও সাতটি অনুলিপি প্রস্তুত করেন। এরপর বিভিন্ন প্রদেশে আল-কুরআনের এক এক কপি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ফলে পবিত্র কুরআনের পাঠরীতি নিয়ে মুসলমানদের অনৈক্য দূর হয়। আল-কুরআন সংরক্ষণের এরূপ অসামান্য অবদানের জন্য হযরত উসমান (রা.)-কে জামিউল কুরআন বলা হয়। জামিউল কুরআন অর্থ কুরআন সংকলক বা কুরআন একত্রকারী।
দলগত কাজ: এই পাঠ পড়ে কুরআন সংকলন সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা কয়েক দলে বিভক্ত হয়ে আলোচনা করে একটি সারসংক্ষেপ লিখবে। |
Read more